কমলকুমার ও ‘অন্তর্জলী যাত্রা’ : শিল্পীর দেখার চোখ / খোরশেদ আলম

Shohoj Path2 komol-kumar

সমকালীন বাংলা কথাশিল্পে কমলকুমার মজুমদার আলাদা; একথা যদিও প্রায় প্রখ্যাত সবশিল্পীর ক্ষেত্রেই বলা যায়- তবুও নানা দিক থেকেই লেখক হিসেবে তিনি ব্যতিক্রম। শিল্পী হিসেবে তাঁর দেখার চোখটি বড় সাংঘাতিক। সাংঘাতিক এ-কারণেও যে অত্যন্ত আণুবীক্ষণিক বিষয়কেও তিনি চিত্রের পর চিত্র সাজিয়ে, অনুভবের ওপর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার প্রলেপ দিয়ে শৈল্পিক অভিব্যক্তি দিতে পারেন। পুরনো ভারতবর্ষে তাঁর শিল্পের মনোজগৎ চলাচল করলেও ঐতিহ্যিক টানটাকে অন্ধকার থেকে তিনি আলোয় নিয়ে আসেন। পুরনো জিনিসকে ভেঙে নতুন জিনিস গড়া হল অথচ তা বর্তমানকে অতিক্রম করে গেল- হাতের কাছে এমন উদাহরণ খুব কম। নিজের পোষাকে ও ভাষার ব্যাকরণে কমলকুমার প্রাচীনপন্থি-একথায় সায় দিয়েছেন প্রায় সকলেই। কিন্তু তাঁর মনটি পুরনো একথা বলার সাধ্য সম্ভবত কারুর নেই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর বেশি নয়। ১৯৪১ সালে এফ.এ. পাশের পর কলকাতায় কর্মসন্ধানে এলেন। কর্মে যোগ তাঁর বিশেষ ঘটল না। একসময় ব্যবসা করে অর্থ করলেন। তাও একটি স্বর্ণযুগ পেরোলেই ক্ষান্ত হল। আসলে তুমুল আড্ডার ভেতর থেকেই নিজেকে চেনা তাঁর। কলকাতার কফি হাউস, খালাসীটোলার মদের দোকান, চিত্তরঞ্জন এভিনিউয়ের কফি হাউস, পরিতোষ সেন, বিষ্ণু দে প্রমুখ চিত্রশিল্পী কবিদের বাড়ি, সিগনেট প্রেস, শেষদিকে ‘চতুরঙ্গ’, ‘সুবর্ণরেখা’র অফিস তাঁর মনোভূমি গড়বার পেছনের শক্তি।

চিত্রকলা সঙ্গীত নাটক ফরাসিসাহিত্য চলচ্চিত্র- শিল্পের নানাজগতে বিচিত্র আগ্রহ ছিল কমলকুমারের। আটপৌরে জীবনেও একজন মানুষ হিসেবে তিনি কথা বলতেন অন্য ভঙ্গিতে। অদ্ভূত সব কাণ্ড করবার অভ্যেস থেকে কখনো রাগ কখনো গালাগালি কখনো সাপসাপান্ত করেও গলাগলি- চরিত্রের এই দ্বিমুখিতা ছিল তাঁর স্বভাবজ। সদ্যপ্রয়াত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মানুষ কমলকুমার সম্পর্কে ‘দৈত্যকাহিনী’ নামক একটি প্রবন্ধে যেসব কথা প্রকাশ করেছেন তাতে একজন মানুষ ও শিল্পীর ‘দৈত্য-আচরণে’র মধ্যে ব্যতিক্রমী এক মানুষের চিন্তা মনের কোনায় বাসা বাঁধে। ‘হরবোলা’ নাটুকে দল গঠনের মধ্য দিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কমলকুমারের সংস্পর্শে আসেন। প্রত্যেক মানুষ সম্পর্কে প্রথম দর্শনের যে ‘স্নবারি’ থাকে তা ভেঙে যায় তাঁর প্রথম দিনেই। কারণ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আশা করেছিলেন- যিনি নাট্য-পরিচালক তাঁর চেহারা বুঝিবা বিশাল ব্যক্তিত্ববান হোমরা-চোমরা গোছের কেউ; অন্ততঃ তাঁর ভাষায়, ‘প্রথমেশ বড়ুয়ার মত রূপবান ও সাহেবী ব্যক্তিত্বময় কেউ।’ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিরাশ হয়েছিলেন তাঁর কুচকুচে কালো চেহারা, গায়ে ধূতি পাঞ্জাবী পড়া, পরিষ্কার নয় কাঁধে এমন একটি চটের তৈরি র‌্যাশন ব্যাগ দেখে। কিন্তু পরবর্তীকালে ঐ-চটের ব্যাগটির ভেতর আবিষ্কার করেছিলেন নানা দেশি-বিদেশী বিশেষতঃ ফরাসি সাহিত্যের বই। তাঁকে স্কারোঁ নামক মধ্যযুগীয় এক ফরাসি কবির রচনা পড়তে দেখে তিনি হতবাক হয়েছিলেন এ-ভেবে যে খোদ ফরাসিই অনেকে হয়ত এ-কবির রচনা পড়েননি। স্কারোঁ কিংবা ভিয়োঁর মূল রচনা এমনকি কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ‘হারামণি’ থেকে কথার ফাঁকে হবহু উদ্ধৃতি করতেন তিনি। প্রথমদিন সুনীল বাবু হতচকিত হয়েছিলেন তাঁর মুখে ঊনবিংশ শতাব্দির বইতে পড়া-  ‘বাবুটির নাম কী? বাবুটির কী করা হয়? বাবুটির পিতার নাম? থাকা হয় কোথায়?’ এ-জাতের ভাষা শুনে।

এ-মানুষটিকেই তিনি আবার বলেছিলেন ‘দুর্মুখ’- বন্ধু বিচ্ছেদে যাঁর কোন জুরি নেই। কিন্তু ১৫/২০ বছরের তরুণ বন্ধু গোষ্ঠীর আন্তরিক আড্ডা তাঁর নিত্যসঙ্গী। শুধু সাহিত্য নয়, ব্যক্তিমানুষ কমলকুমারের আকর্ষণ সেখানে ছিল বড়। তিনি কমলকুমারের আরেকটি অদ্ভূত স্বভাবের কথা বলেছিলেন তা হল- তাঁর অজ্ঞাতবাস। বাড়ির ঠিকানা সহসা তিনি কাউকে দিতেন না। একরকম গোয়েন্দাগিরি করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর বাসা খুঁজে পেয়েছিলেন যশোর রোডের ধারে। সবার কাছে এই আড়াল থাকার কথা বলেছিলেন আরো একজন অসমবয়সী বন্ধু, তিনি শান্তি বসু। জীবনযাপনে রসময় কিংবা অমিতব্যয়ী হলেও তথাকথিত আভিজাত্যের গৌরব কমলকুমার পছন্দ করতেন না। অনেকের ফাঁপা জীবনযাপন তাঁর কাছে বিদ্রুপাত্মক যেহেতু তিনি বিশ্বাস করতেন ‘আভিজাত্য শিল্পের নয়, বড়জোর জীবন যাপনের।’ ইচ্ছে করে নিজের ধবধবে পাঞ্জাবীর পকেটে পানের পিক ফেলে তাই তিনি ময়লা করতেন।

যে-আধুনিকতার বীজ বোনা হয়েছিল পাশ্চাত্যে তাকে সযত্নে এড়িয়ে চলাই ছিল কমলকুমারের অনন্তপ্রয়াস। দ্বিধাবিভক্তিমূলক একটি আধুনিকতার মধ্যে আধুনিক ভারত-মানুষের চৈতন্য নির্মিত। নকল-নবিশি এই আধুনিকতার খোলস পরিত্যাগে কমলকুমার একটি প্রতিবাদও। রামপ্রসাদ, ঠাকুর রামকৃষ্ণের লোক-অভিজ্ঞান, বঙ্কিমের ধর্মবোধ-ভাষাবোধকে তিনি ধারণ করেছেন। স্বস্তিবচন কিংবা রামকৃষ্ণ-তারাময়ী, কালীর নাম গ্রহণকারী কমলকুমার, তাঁর রচনা মধ্যযুগের সাহিত্যে ভণিতা করার একটি লক্ষণও বৈকি। তিনি রবীন্দ্রনাথকে খুব একটা স্বীকার করেননি। অথচ রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’ অভিনয়ের সময় একটি শব্দও বাদ দেবার পক্ষপাতী ছিলেন না।

কমলকুমার বাঙালি হিন্দু, মূর্তিপুজা সংস্কৃতিতে তাঁর বদ্ধমূল বিশ্বাস; কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা তাঁর লেখায় কোথায় সেটা বের করা মুশকিল হবে। তেমনি মুশকিল হবে তাঁর রচনার মধ্যে কোনো শ্রেণি-ব্যবধানকে আবিষ্কার করা। অথচ তিনি কখনো পুরনো ধারার সামন্ত-সংস্কৃতির অন্তঃসার কখনো খাঁটি বুর্জোয়াত্বকে ধারণ করতে চেয়েছিলেন। মানুষে-মানুষে পার্থক্য-জ্ঞানকেও শৈল্পিক-অভিজ্ঞা দিয়ে প্রকাশ করতে চেয়েছেন তিনি। নানাদৃষ্টিতে কমলকুমার মজুমদার বইয়ের ‘বাবু শ্রী কমলকুমার মজুমদার’ নামক প্রবন্ধের লেখক শান্তি বসুর বক্তব্য সঙ্গত কারণেই এখানে প্রণিধানযোগ্য,

কমলবাবু জানতেন আমাদের আদি-পুরুষরা আর যাই হোক পাশ্চাত্যকে মোটেই ধাতস্থ করতে পারেনি। তাই তিনি পাশ্চাত্যের পাঠ তাঁদের কাছে নেননি, জানতে গিয়েছিলেন পাশ্চাত্যের মন পাশ্চাত্যের সর্ববিধ চর্চার মধ্য দিয়ে। সেই চর্চা শুধু শিল্পসাহিত্যই নয়, দর্শন বিজ্ঞানও নয়। তার তাবৎ অভ্যুত্থানের ইতিহাস ও কার্যকারণ। যে-কারণে তিনি প্রতিবাদ সত্ত্বেও কার্লমার্কসের সুসমাচারেও বঞ্চিত ছিলেন না। শুধু সুসমাচারের কারণেই নয়, বুর্জোয়া অভ্যুত্থানের গোটা ইতিহাসই মুঠোয় ধরতে চেয়েছেন।

অপরপক্ষে শিল্পের নৈর্ব্যক্তিক এক সম্পর্কসূত্র তৈরি করেন কমলকুমার মজুমদার। তাঁর নিবিষ্ট দেখার এক কৌশল চিত্রময়তার সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি করে। শিল্প করার ক্ষেত্রে কমলকুমারের আচরণ গোড়া বাঙালি হিন্দুর মতই। ‘হরবোলা’ নাট্য-গোষ্ঠীতে মুক্তধারা অভিনয় করতে গিয়ে নাটকের মঞ্চে খালি চোখে দেখা যায় না এমন বিষয় নিয়েও তিনি হুলস্থূল কা- বাধিয়েছিলেন। সব আয়োজন শেষে সামান্য দু-এক ইঞ্চি উঁচু হওয়া মঞ্চে দর্শকদের তিনি অভিনয় করতে দেবেন না। অবশেষে ট্রাক ট্রাক মাটি এনে র্দকশদের বসার জায়গা উঁচু করা হয়েছিল। এরকম উদাহরণ অনেক আছে। ফরাসি চলচ্চিত্রকার জাঁ রেনোয়া ‘দ্য রিভার’ ছবির শ্যুটিং করতে এলে স্থান নির্বাচন থেকে শুরু করে নানা বিষয়ে তিনি সাহায্য করেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে এটাও বলতে ভোলেননি, বাংলাদেশে ছবি করতে এলে হোটেলে থাকলে চলবে না। লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করতে হবে, রাস্তাঘাটে ঘুরতে হবে, রোদে পুড়তে হবে, একপেট খেয়ে গরমকালে বটগাছের ছায়ায় ঘুমোতে হবে, জলে ভিজতে হবে, গঙ্গার রূপ দু’চোখ ভরে দেখতে হবে।

এই হচ্ছেন কমলকুমার; শিল্পে কারো সঙ্গে যার কোন আপোস নেই। জানা যায়, কথাসাহিত্য করার আগে তিনি চলচ্চিত্রকার হতে চেয়েছিলেন। চলচ্চিত্র এমন এক শিল্প যেখানে বাস্তবতাকে ক্যামেরাবন্দি করা হয়; এ-হেতু চলচ্চিত্রকারকে যথাসম্ভব অনেকগুলো ছবির ফ্রেম যুক্ত করতে হয়। ছবিগুলো আলাদা কিছু নয়, কিংবা বিভিন্ন সময়ে তোলা স্ন্যাপশটও নয়। বরং একটি চলমান ঘটনায় তাকে বাস্তবের প্রতিকল্প করে তুলতে হয়, সমাজবোধের প্রবল চৈতন্যকে ব্যক্তি চরিত্রগুলোর অভিব্যক্তিতে ব্যঞ্জিত করতে হয়; যা কথাশিল্পেরও বিষয়।

অন্তর্জলী যাত্রা কমলকুমারের যুগপৎ প্রথাবিরোধী ও সাড়া জাগানো উপন্যাস। উপন্যাসে কাহিনির ব্যাপ্তি তেমন কিছুই নয়- একটি সতীদাহকে কেন্দ্র করে শ্মশান ও শ্মশানে উপস্থিত চরিত্র যশোবতী, সীতারাম, লক্ষ্মী নারায়ণ, অনন্তহরি, কৃষ্ণপ্রাণ, বৈজুনাথ প্রভৃতি চরিত্রের ভেতর দিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর ন্যাক্করজনক এক বাস্তব ঘটনার উপস্থাপন। যে ‘সহমরণে’র বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, এ-উপন্যাসে সে-শব্দকে কমলকুমার এড়িয়ে চলেন। বরং ব্যবহার করেন ‘সতীদাহ’। জীবনকে এমন নৈর্ব্যক্তিকভাবে শিল্পে প্রকাশ হৃদয়ে নাড়া দিতে সক্ষম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ইউরোপে অনেক লেখকের হাতে উপন্যাস তৈরি হয়েছিল। সেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শব্দটি যথাসম্ভব পরিহার করে মানব-জীবনের সঙ্কটকে তুলে ধরা হয়েছিল। একঘেয়ে বাস্তবতার পাশ কাটাতেই এমনটা কীনা ভেবে বিস্মিত হই আমরা।

উপন্যাসটি ভিন্নধর্মী হয়ে উঠেছে এর চিত্রময় পরিস্থিতি আর ব্যতিক্রমী ভাষানির্মাণের জন্য। বঙ্কিম-রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্রের উপন্যাস-কথনভঙ্গি এমনকি কল্লোলের উতরোলকেও তিনি যেন সচেতনে এড়িয়ে গেছেন। ছবি আঁকার বিষয়টি চিত্রশিল্পে ছিল; কিন্তু উপন্যাসে নতুন। পিকাসোর কথায়, “আমরা বাস্তবতাকে মুছে ফেলতে পারি, যদিও এতে ভয়ের কিছু নেই, যেহেতু ঐ বস্তু তার অনপনেয় দাগ রেখে যায়।” কমলকুমার তাঁর এ-রচনায় বাস্তবতার সেই অনপনেয় দাগটি রেখে গেছেন, যা বহুবছর যাবৎ শিল্পীর মনের কোনায় হয়তবা সংগুপ্ত ছিল। কমলকুমার যাকে জানি শুচিবায়ুগ্রস্ত, তিনি সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালীর চলচ্চিত্র রূপ দেখার পরে নিরাশ হয়েছিলেন। জাপানী ‘রাশোমনে’র মত চলচ্চিত্রও তাঁর মন জোগাতে পারেনি। পথের পাঁচালী দেখে, ময়রার পেছনে ছুটবার সময় অপু ও দুর্গার যে দৌঁড় সেটা শুধু তাঁর মনে ধরেছিল, এ-ছাড়া আর কোন মন্তব্য তিনি করেননি। তারপর অসূয়াবশতই হোক আর যাই হোক চলচ্চিত্রে পা বাড়াননি।

কমলকুমার মজুমদারের অন্তর্জলী যাত্রা উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৫৯ সালে। ফ্রান্সে ১৯৫০ সালে ‘নোভো রোমান’ বা ‘নভো নভেল’ তত্ত্বের জন্ম। অ্যালা রবগ্রিয়ে, নাতালি সারোৎ, ক্লদ সিমো, মার্গারেট দারুস, মাইকেল বাটোর, ফিলিপ সোলারস প্রমুখ লেখকদের হাতে এ-ধরনের উপন্যাস গড়ে ওঠে। প্রথাগত উপন্যাসের বাস্তবতাকে এড়িয়ে নৈর্ব্যক্তিকতার প্রতিনিধিত্ব করাই হল এ-ধরনের উপন্যাসের মূল বিষয়। সময় ও স্থানের ধারণাকে ভাঙে এ-ধরনের উপন্যাস। তাছাড়া কথাসাহিত্যে বহু প্রচলিত বর্ণনা ও উপমা-রূপকের জগতকে এগুলোতে সাধারণত ব্যবহার করা হয় না। মূল বিষয়কে ব্যাখ্যা করার জন্য নানা দ্ব্যর্থবোধকতা ও বিরোধাভাস সৃষ্টি করা হয়। তবে এটা পরিষ্কার, নভো-নভেল তত্ত্বের আগেই কমলকুমারের অন্তর্জলী যাত্রার প্রকাশ। সমকালীন ইউরোপে আরেক জাতের উপন্যাস তৈরি হচ্ছিল যেগুলোতে কিউবিজমের প্রভাব পড়েছিল। যুদ্ধোত্তর ইউরোপের ভাঙচুর এক সময়ের তীব্রদহন ফুটিয়ে তোলার জন্য তা ব্যবহার করা হত। কমলকুমার ইংরেজ-পূর্ববর্তী এক অমানবিক ঘটনাকে অন্তর্জলী যাত্রায় অঙ্কন করতে বাস্তবের অনুপুঙ্খ ক্রিয়াশীলতাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তবে পরিসর যত ছোটই হোক এতে আদি-মধ্য-অন্ত্য খুঁজে পাওয়া দুষ্কর নয় মোটেও। কাজেই আমার মতে এটিকে কিউবিস্ট ধারার পক্ষপাতি উপন্যাস না বলাই ভাল। তবে এ্যানালিটিক কিউবিজমের প্রকাশ-ভঙ্গির প্রতি তাঁর দুর্বলতা ছিল। সে-কারণেই ঘটনার বিবরণ নয়, বিন্যাসের ইলাস্টিসিটি দিয়ে পাঠককে তিনি কাব্যিকতার ধুম্রজালে নিমজ্জিত করান।

বাংলা উপন্যাসের প্রচলিত ধারায় বাস্তবতাকে যেভাবে প্রকাশ করা হয়েছে অন্তর্জলী যাত্রা তার থেকে আলাদা। একটি প্রবল বাস্তব সমাজ-ধারণা এমনকি চরিত্রের ক্রিয়াকলাপ সবকিছুই এ-উপন্যাসটিতে উপস্থিত। কেবল কমলকুমারের একটি স্বতন্ত্র্য-কথনভঙ্গির কারণেই তা ব্যতিক্রম। চিত্রের পর চিত্র সাজিয়ে চলচ্চিত্রের মত এর দৃশ্যপট যেন তৈরি করা, উপরন্তু এটি চিত্রশিল্পীর হাতে নির্মিত অপূর্ব চিত্রকলাও। রঙের ব্যবহারের কারণে তা ইম্প্রেশনিস্টি শিল্পীদের তৈরি চিত্রকল্প বলে অভেদ হয় কখনো কখনো। উপন্যাসটি যেভাবে শুরু হয় :

“ক্রমে আলো আসিতেছে; এ নভোমণ্ডল মুক্তাফলের ছায়াবৎ হিম নীলাভ। আর অল্পকাল গত হইলে রক্তিমতা প্রভাব বিস্তার করিবে, পুনর্বার আমরা, প্রাকৃতজনেরা, পুষ্পের উষ্ণতা চিহ্নিত হইব। ক্রমে আলো আসিতেছে।”[অন্তর্জলী যাত্রা, পৃ. ১]

এই আলোক সম্ভাবনা নীলাভ কিংবা রক্তিম ভাবের মধ্যে আছে চিত্রশিল্পের দ্যোতনা। অন্যদিকে প্রকৃতির উপকরণসমেত তা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দ্বারা তুল্যমূল্যে স্বীকৃত। প্রাকৃতজনের উদ্ভাসনও সেখানে থেমে নেই। একজন শিল্পী সমাজবিবিক্ত হতে পারেন না কখনো। সৎশিল্পীর অভিব্যক্তি তাই শিল্পপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই সত্যের বৈভবকে ধারণ করে। একটি সমাজের অচলায়তন ভাঙতেও সে-শিল্প বোদ্ধাজনের কাছে নির্মিয়মান আলোকিত জীবনের সন্ধান দেয়। ‘প্রাকৃতজনে’র ‘পুষ্পের উষ্ণতা’ প্রাপ্তির অর্থ তাই স্বকীয় প্রাকৃতিক অবস্থার ভেতর দিয়েই নতুন জীবনের সন্ধান লাভ। কমলকুমার তাই কথায় হিন্দু হলেও কার্যত মানবিক-সংশোধন প্রক্রিয়াতেই রাজি। সে-কথা তাঁর শিল্প-সম্ভব বিভ্রমের জগত দিয়েই প্রমাণিত হয়। উপন্যাসের প্রান্তে এসেও সেই আলোকপ্রত্যাশী প্রাকৃতজনের মায়াপ্রপঞ্চকে তিনি ব্যবহার করেন। একসময়ে উড্কাঠ নিয়ে হাতুড়ি-বাটাল চালিয়ে ভাস্কর্য নির্মাণকারী শিল্পীরও মেজাজ তাতে ধরা পড়ে।

“একটিমাত্র চোখ, হেমলকে প্রতিবিম্বিত চক্ষুসদৃশ, তাহার দিকেই, মিলন অভিলাষিণী নববধূর দিকে চাহিয়াছিল, যে চক্ষু কাঠের, কারণ নৌকাগাত্রে অঙ্কিত, তাহা সিন্দুর অঙ্কিত এবং ক্রমাগত জলোচ্ছ্বাসে সিক্ত, অশ্রুপাতক্ষম, ফলে কোথাও মায়া রহিয়া গেল।” [অন্তর্জলী যাত্রা, পৃ. ১৬৭]

বুঝতে বেশি বেগ পেতে হয় না- কমলকুমারের কাছে যে জগত মায়া তা তাঁর সনাতন ধর্ম অনুধ্যানের ফসল। বৈজুনাথ সেই জাগতিক মায়া। কিন্তু সে মায়াই শিল্পনির্মাণের কাক্সিক্ষত ফলাফল; যেন চণ্ডাল বৈজুনাথ একা নয়, সমগ্র মানব-সভ্যতা তার বাঞ্ছিত জীবন-প্রত্যাশী।

অন্তর্জলী যাত্রা উপন্যাসটিতে চাঁড়াল বৈজুনাথের যাতনা, কামনা, শ্লেষ, বিরক্তি, ভালবাসাসহ মানস-প্রক্রিয়ার অনেককিছুই প্রদর্শিত। তবুও মনে হয় বৈজু কি সত্যি এভাবেই কথা বলতে পারে? কখনো লেখক কি তার ভেতরে অনুপ্রবেশ করেন না? “ই যে মহাটোল বটেক, কত ডাগর ডাগর পণ্ডিত আচাজ্জিই যেন পাঠ দেয় গো, কত যুক্তি আঁটে, আমি শুনি…হ্যাঁ…আমি শুনলাম বটে তত্ত্বকথা বেজায় জানি হে, আত্মার সাকিম কুত্থাকে, তার থানা কোথা, আমি যে তার শরিক।” অনার্য বৈজুর মুখের এ-ভাষা রামকৃষ্ণের শরণাগত কমলকুমারের ব্যক্তিবিভায় আক্রান্ত। শিল্পে যা কিছু ব্যক্তিগত তাকে মহাআক্রোশে অতিক্রম করতেই হবে এমন কথা কমলকুমারও হয়ত মনে করেননি। বরং ভারতবর্ষের গোটা সমাজটা তাঁর শিল্পের অবচেতনে ধরা পড়ে। বৈজুনাথ যদি ভারতবর্ষীয় চোখ তবে মানুষ সম্পর্কে তার জানতে বাকি নেই। আর্তনাদ আর হাহাকারের ধ্বনি তাকে গ্রাস করে, সে উচ্চারণ করে, “আ হা… মানুষ এক অচিন গাছ, মানুষ বড় ডাগর জীব গো, কাঠের বিড়াল দিয়ে ইন্দুর ধরে… তাই না?”[অন্তর্জলী যাত্রা, পৃ. ১২০]  লক্ষ্যণীয় এই ‘অচিন’ শব্দটি এখানে আধ্যাত্মিক ভাব-বিশিষ্ট নয়। কাঠের বিড়াল দিয়ে ‘ইন্দুর’ ধরবার প্রসঙ্গ জড়বৎ তথাপি শক্তিমান সমাজশক্তির কাছে সজীব মানুষের মৃত্যু। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বসবাস করেও মানুষের যে পরাধীনতা সে দোষ উপনিবেশের কতটা, তা খতিয়ে দেখতে পেছন ফিরতে হবে। বৈজুও যখন মৃতপ্রায় সীতারামকে দেখে বলে, “আমি শালা ডর করি না… দু শালা! মা আমার কোম্পানী, আমার আবার ডর কিসের… ভাবি দি শালা একটা কুড়–ল মেরে… শালা বলে কি না আমি তোকে শান্তি দেব, হা! শান্তি!” বৈজুনাথের এই কুড়াল মারার ইচ্ছা কিংবা কোম্পানির শরণ নেয়া উভয়ই জটিল বিষয়। উপন্যাসের শেষতক পৌঁছাতে হয় সীতারাম ভেসে যাবার ‘রক্তিম জলোচ্ছ্বাস’ দেখতে; তাহলে বৈজুর কোম্পানির শরণাগত হওয়া কেন? ক্রমশঃ বৈজু নিজেই যখন সীতারামের নিয়ন্তা হয়ে যায়। সতীদাহ রোধকারী ইংরেজ কোম্পানির প্রতিই তাহলে বৈজুর বিশ্বাস প্রথমদিকে। আর এটি স্বদেশের শাসন-কাঠামোর প্রতিই বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন। যা বৈজু একাই পারে, সে-বিশ্বাস উৎপাদিত হতে অনুভব ও বাস্তবতার অনেক কাঠখড়ি তাকেও পোহাতে হয়। বৈজুর স্ত্রীর সতীদাহ হয়েছিল পঞ্চমুণ্ডির ঘাটে। এই পঞ্চমুণ্ডির ঘাট ডুবে গেলে বৈজু মা গঙ্গারই অভিশাপ বলে ভাবে। সেই বৈজুর ভেতরে এমন এক পরিবর্তন ঘটল যা অভাবিত। একই সঙ্গে ‘প্রাকৃতজনের পুষ্পের উষ্ণতা’ প্রাপ্তির সময়ও পাঠকের মধ্যে উপস্থিত হল।

ভারতীয় বা বাঙালি ইতিহাসের অমোঘ টানে আধুনিক পর্বে এসে সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে হারিয়ে ফেলে। কমলকুমারের সচেতনতা ছিল বলেই উপন্যাসের পরিবেশ, উপকরণ, থিম, মিথের জগত ইত্যাদি নানাকিছুর মধ্যে তিনি স্বীয় সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত ঐশ্বর্যকে আবিষ্কারের প্রয়াসী হয়েছিলেন। নৃত্য-সঙ্গীত ভারতের শিল্পের আত্মা। হরিনাম কীর্তনের আবহের সঙ্গে নৃত্য-সঙ্গীতের আবহ থাকে। শ্মশানের পরিবেশে সে-দৃশ্যপটকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে সজ্জিত চিতা, প্রধূমিত পরিবেশ, ভয়াবহতা, অন্ধকারাচ্ছন্নতা অবরুদ্ধ মনো-টানাপড়েন তৈরি করে।

অ্যালা রবগ্রিয়ে, নাতালি সারোৎ-সহ অনেকের ‘নব-উপন্যাস’ তাঁর পড়া থাকলেও পাশ্চাত্যের ধ্বজা ধারণ করতে আদতেই কমলকুমার চাননি। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন থেকে জানা যায়- নভো-নভেল আন্দোলনের অন্যতম দুই প্রতিভূ নাতালি সারোৎ ও ক্লদ সিমোর সঙ্গে তাঁর পত্র যোগাযোগ ছিল। নাতালি সারোৎ কলকাতায় এলে লোকনাথ ভট্টাচার্যের বাসায় তিনি বৈঠকও করেছেন। কিন্তু প্রচলিত ভাষাকাঠামো ভাঙার যে-অভিপ্রায়কে নভো-নভেলের প্রভাবজাত বলে আমরা মনে করেছি এর পুরো কৃতিত্ব কি তাদের? কমলকুমার তাঁদের কথা তেমন উচ্চারণই করেননি। বরং কমলকুমার বিদ্যাসাগরের ভাষায় লিখতে পারলে শান্তি পেতেন আর বঙ্কিমচন্দ্রের মত ভারতের ঐতিহ্যকে ধারণ করতে পারলে বেঁচেবর্তে যেতেন- একথা বারবারই বলেছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন, ‘রচনা পদ্ধতি আবার কি; তোমরা শিক্ষিত যুবক, তোমরা যাহাই লিখিবে তাহাই রচনাপদ্ধতি হইবে, তোমরাই ভাষা গঠন করিবে।’ বাংলাভাষার গদ্যনির্মাণের ইতিহাসের ব্যপারেও কমলকুমার সচেতন ছিলেন। যে-কারণে বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে মধুসূদন, কেশব বাবু, ঈশ্বরগুপ্ত, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার প্রমুখ সবার ভাষা বিষয়ে তাঁর অনুপুঙ্খ অধ্যয়ন ছিল। বাংলাভাষার গদ্যছন্দের ব্যাপারেও তিনি ওয়াকিবহাল। অন্যদিকে গুরুচণ্ডালী দোষেও ভরপুর তাঁর রচনা। মনে হয়, লৌকিক বাংলাকেই ধরার একটা গুরুগিরি তিনি করেছিলেন।

কলকাতার অনেক মার্কজিস্ট লেখকরা যখন নিম্নশ্রেণির মানুষদেরকে নিয়ে সাহিত্য রচনা করছেন এবং নানা তত্ত্বের ছত্রে তাকে উষ্ণতা দেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত তখন কমলকুমার তার বিরোধিতাই করেছিলেন। তাঁর ভাষ্য, “সাহিত্য মুভমেন্ট খুব গোলমাল হয়ে গিয়েছে। সাহিত্য এখন হয়েছে কি জানেন? আমি ভীষণ বিরক্ত। আপনার কথা আমি কিছু বলতে পারব না হঠাৎ দারিদ্র্যের কথা বস্তির কথা বলে বসলাম। সোসাল কন্টেন্ট এটাতে, হোল ভারতবর্ষ এইটেতে ভুগছে।” শিল্পী হিসেবে কমলকুমার মজুমদারের কর্ম সাহিত্যের সৌখিন মজদুরি করা নয়। আধুনিকতার ‘টবে ফলানো, ক্ষয়া ও খেঁকুরে’ ভাবটা তাই তিনি মানেননি। শুধু অন্তর্জলী যাত্রার বৈজু নয়, পিঞ্জরে বসিয়া শুক উপন্যাস এবং কোন কোন ছোটগল্পে বিহারের সাঁওতাল পরগণার রিখিয়ার যে চিত্র উঠে এসেছে তা তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও গভীর পর্যবেক্ষণের ফল। সুঘরাই নামক চরিত্রের এখানেই জন্ম। সুবিধা-বঞ্চিত ব্রাত্যজন সাঁওতালরা রাষ্ট্রের কেন্দ্র থেকে কতটা দূরে তা এ-উপন্যাসে স্পষ্ট। খেলার প্রতিভা নামক উপন্যাস যুদ্ধোত্তর কলকাতার বিষময় ফল। ‘পাজী’ রাজনীতিতে তাঁর কোন বিশ্বাস নেই বলেই কমলকুমার তাঁর ধারণাকে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে চিঠিতে লিখেছিলেন। যখন তাঁর কাছে ‘গুরু’ মানে ‘পাবলিক রিলেশন্স’-এর ব্যাপার তখন সে-কথা না হয়ে যায় কোথায়? এটা প্রায় সকলেরই জানা যে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে তিনি গুরু মেনেছিলেন। একটি সাক্ষাৎকারে গুরুবাদ নিয়ে তিনি বলেছিলেন, আর গুরু- “ওটা আপনাকে গোপনে বলি, ওটা হচ্ছে পাবলিক রিলেশন্স।” কমলকুমার মজুমদার তাঁর অন্তর্জলী যাত্রায় সামন্ত-অর্থনীতি চোষক অন্তঃসারশূন্য একটি ব্রাহ্মণশ্রেণিকে ব্যঙ্গাত্মক করে তুলেছেন। পৌরোহিত্য ও জ্যোতিষী বিদ্যার সঙ্গে সম্পত্তির রক্ষকদের একটি যোগসাজস বৃদ্ধস্য সীতারাম, কৃষ্ণপ্রাণ ও অনন্তহরি চরিত্রগুলোতে লক্ষ্যণীয়। এমনকি লক্ষèীনারায়ণ পিতা হলেও ব্রাহ্মণ্যশ্রেণির পোষণনীতির পূজক।

সমকালীন সমাজে সামন্ত-অর্থনীতি ভেঙে প্রতাপান্বিত পুঁজি প্রাধান্য বিস্তার করলেও কমলকুমারের প্রাচীনপন্থিতা বিষয়ে প্রশ্ন উদ্রিক্ত হয়। কিন্তু কমলকুমারই তো একথা বলেন, “ক্লাসটা যেন আর্থিকভাবে চলে গেল। মেন্টাল এইটাতো রয়েই গেছে।” স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পরেও ভারতের অবস্থা সঙ্গীন। স্বাধীনতার ধূয়া তাই ব্যক্তিগত পর্যায়ে রয়ে গেলেও পুরো ভারতবর্ষের অবস্থা পরিবর্তিত হয়নি। অন্যদিকে সাহিত্যের সেবা করার নিমিত্ত বৌদ্ধিকমহলে যারা বিরাজ করছিলেন তারাই বা কতটুকু দায়িত্ব নিতে পেরেছিলেন? তিনি বারবার ইঙ্গিত দিয়েছেন যে প্রাচ্য আদর্শের প্রাণের উৎস থেকে আমরা বিচ্যুত হয়েছি। সত্যজিৎ রায় তাঁর স্মৃতিচারণামূলক প্রবন্ধ ‘কমলবাবু’তে উল্লেখ করেছেন, “জনৈক বামপন্থী এক কবিকে আক্রমণ করে কমলকুমার বলেছিলেন, ‘ভদ্রলোক সোশ্যাল কনটেন্ট না থাকলে নস্যি নেন না। চাষী-মজুরদের হাল সম্পর্কে শহরের মার্কসিস্ট বাবুরা উৎকণ্ঠিত সে কথা চাষী-মজুর জানে কি?’ কমলবাবুর ভাষায়, ‘ব্যাঙের যে একটি লাতিন নাম আছে ব্যাঙ তা জানে কি?” কমলকুমার বস্তির ছেলে-মেয়েদের জন্য বিনাবেতনে শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করেছিলেন। সমরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত একরকম জোর করে ‘কৃত্তিবাস’ ও ‘বিভাব’-পত্রিকার লেখার জন্য টাকা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে টাকা তিনি গ্রহণ করেননি, তা বস্তির ঐ ছেলেমেয়েদের ওষুধের জন্য দিতে বলেছিলেন। সামাজিক কাজটা আলাদা নয়, যদিও শিল্প ব্যাপারটা তাঁর কাছে অন্যরকম, সেটা না হয়ে ওঠা পর্যন্ত তাঁর বিশ্বাস নেই। গণসমাজ সংস্কৃতি চায় না, চায় আমোদ। কমলকুমার আমোদ দিতে চাননি, শিল্পে পরিশ্রমসম্মত আনন্দের কারিগরি করেছেন। যেমন করে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কথাশিল্প গণসাহিত্য নয়, গণমানুষের সাহিত্য। জনগণের আমোদ যোগাতে চাননি কমলকুমারও কিন্তু তাই বলে জনগণের কথা তাতে কিছু কম নেই।

সহায়ক তথ্য-নির্দেশিকা

১.    কমলকুমার মজুমদার, অন্তর্জলী যাত্রা, সুবর্ণরেখা, প্রথম প্রকাশ তৃতীয় মুদ্রণ, কলকাতা-১৩৯৫
২.    অর্ঘ্যকুসুম দাশগুপ্ত (সম্পা.), নানা দৃষ্টিতে কমলকুমার মজুমদার, সমতট প্রকাশন, প্রথম প্রকাশ : ১ মে ১৯৯৩
৩.    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ‘দৈত্যকাহিনী, কাব্যবীজ ও কমলকুমার মজুমদার (সম্পাদক : বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিত), নবার্ক, কলকাতা, ডিসেম্বর-১৯৮৫
৪.    শোয়াইব জিবরান, কমলকুমার মজুমদারের উপন্যাসের করণকৌশল, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, আষাঢ় ১৪১৬/জুন ২০০৯
৫.    কার্তিক লাহিড়ী, ‘চিত্রসংগীতস্থাপত্যময় অন্তর্জলী যাত্রা’, সৃজনের সমুদ্র মন্থন, অন্বেষা, প্রথম প্রকাশ, কলকাতা-১৯৮৪
৬.    নাসিম মহিউদ্দিন, ‘কমলপূর্ব বাংলা উপন্যাস এবং অন্তর্জলীযাত্রা’, প্রসঙ্গ কথাসাহিত্য, কাগজ প্রকাশন, একুশের বইমেলা, ঢাকা, ২০০৩
৭.    সুব্রত রুদ্র (সম্পা.), কমলকুমার রচনা ও স্মৃতি, নাথ ব্রাদার্স, কলকাতা, বইমেলা-১৯৮২

লেখক, শিক্ষক
বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
ই মেইল : khorshed.ju.bngl@gmail.com

এখানে মন্তব্য করুন